
রাতের আধাঁরে বাড়িতে গিয়ে ঘুমন্ত শিতার্তদের ডেকে নিয়ে কম্বল তুলে দিয়েছেন পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন একই সাথে রেল ষ্টেশনে থাকা ছিন্নমুল দরিদ্র ও প্রতিবন্ধীদের কাছে কম্বল বিতরন করা হয়েছে। উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে মাঘ মাসের শুর থেকেই শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়, বিশেষ করে রাতে হাড়কাঁপানো শীতে কাবু হয়ে যায় এখানকার জনগন। সেই কারনে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন রাতের আধারে নিজেই কম্বল বিতরনের উদ্যোগ নেয়। গতকাল শনিবার (১৬ জানুয়ারি) রাতে কম্বল নিয়ে বের হয়ে প্রথমে রেল ষ্টেশনে দরিদ্র শিতার্তদের কাছে কম্বল নিয়ে হাজির হয় সাবিনা ইয়াসমিন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেল স্টেশনের প্রধান ফটকের সামনে দেখা যায় কয়েকজন শিতার্ত দরিদ্র , ছিন্নমুল বৃদ্ধা নারী পুরুষ ও শিশু। তারা সবাই রেল স্টেশন সংলগ্ন ঘাটিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা। এ সময় রতন (৩৫) নামে একজন পা- প্রতিবন্ধী শীতের তীব্রতায় কাতর হয়ে আছে তার কাছে গিয়ে কম্বল তুলে দেন ডিসি । রতন আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন কম্বলের অভাবে আইতত নিন্দিবা পাড়ুনা আইজ কুনিক নিন্দাম।
পাশেই পাওয়া গেল আমেনা বেগম (৫০) নামে আরেকজন ছিন্নমুল নারী । আমেনা রোববারের ট্রেনে করে মৌলভিবাজার যাবেন । স্টেশনেই ঘুমাবেন কিন্তু প্রচন্ড শীতে কম্বল নেই তার কাছে। জেলা প্রশাসক তাকে দেখে তাকে কম্বল পড়িয়ে দেয়। কান্নাজড়িত কন্ঠে আমেনা বললেন ঠান্ডায় কাবু হয় আছু মোক কাহ দেখিল নি এইঠে, একটা মাইয়ালোক অয় বলে ডিসি মোক একখান কম্বল দিছে দোয়া করনু আল্লাহ অক ভাল করুক।
এভাবে খায়রুল আলম (৫৫) মোছা. বেগম (৪৫) ও তার ছেলেসহ কয়েকজন ছিন্নমুল ও নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে স্টেশনে কম্বল বিলিয়ে দেন জেলা প্রশাসক।
স্টেশন থেকে গাড়িতে করে ফেরার পথে রেল ষ্টেশন মসজিদের সামনে ঘাটিয়া পাড়া, কমলাপুর, সিএন্ড বি মোড় এলাকার কুড়ি জন নারী পুরুষ শিতার্তরা রাস্তায় জটলা বেধে আছে, ডিসির গাড়ি থামিয়ে দিলে তাদের কথা শুনেন ডিসি। শিতার্তরা বলেন এই মৌসুমে তারা কম্বলের জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে তাদের হাতেও কম্বল তুলে দেন ডিসি। ওই নারী পুরুষদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন এর আগে এইসব বয়স্ক নারী পুরুষদের কেউ কম্বল দেয়নি। ডিসি স্যার যে কম্বল দিয়ে গেলেন এত রাতে এটা আমরা কখনো ভুলবোনা।
স্টেশন এলাকা থেকে বের হয়ে শহড়ের দিকে রওয়ানা দেয় ডিসি। পথিমধ্যে খাদ্য গুদামের সামনে একজন শীতার্ত পুরুষ দেখা যায় গাড়ি থামিয়ে ওই শিতার্তকে কম্বল দেওয়া হয়। শহড় পর্যন্ত রাস্তায় কয়েকটি স্থানে শিতার্তদের কম্বল বিলিয়ে দেন সাবিনা ইয়াসমিন ।
এরপর মুজিবনগড় (তুলারডাঙ্গা) করতোয়া নদী তিরবর্তী গ্রামে কম্বল নিয়ে রওয়ানা দেয় ডিসি। পঞ্চগড় শহড় পার হয়ে পথিমধ্যে রাজনগড় শাহী মসজিদের সামনে রিকশা চালক নুরজামাল (৩০) শুধুমাত্র জামা লুঙ্গি গায়ে দিয়ে রিকশা নিয়ে দাড়িয়ে আছেন । তাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে দেন সাবিনা ইয়াসমিন তার কথা শুনেন এসময় তার হাতে কম্বল তুলে দেওয়া হয়। তার সাথে আলাপকালে বললেন ডিসি মোক কম্বল দিবে এইডা মুই স্বপ্নেও চিন্তা করুনি।
সামনে একশ গজ এগিয়ে রাস্তার পাশের মুদি দোকানদার ঠান্ডায় শীতবস্ত্রের অভাবে বসে আছে । সাবিনা ইয়াসমিন গাড়ি থেকে নেমে দোকানদারকে কম্বল দেয়। পাশেই রাস্তা থেকে নিচু এলাকার একটি বাড়িতে রোজিনা (২৭) নামে এক গৃহিনী খড়খুটো জ¦ালিয়ে শীত নিবারনের চেস্টা করছে। ডিসি সেই বাড়িতে প্রবেশ করে । বাড়িতে রাতের আধারে ডিসিকে দেখে হতবাক হয়ে বললেন কেউ হামার খোঁজ নেয়না এত বড় শীত যাছে। রোজিনার হাতে দুটি কম্বল তুলে দিলেন ডিসি। এভাবে মুজিবনগড় (তুলারডাঙ্গা) যাওয়ার পথে রাস্তার দু পাশের দরিদ্র পরিবারদের ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে কম্বল পৌছে দেওয়া হয়।
এবার মুজিব নগড় (তুলারডাঙ্গা) গ্রামে সাবিনা ইয়াসমিন গাড়ি থেকে নামলেন। শুন শান নিরবতায় সেখানকার পরিবারগুলো ঘুমাচ্ছে। সাবিনা ইয়াসমিন পায়ে হেটে প্রতিটি ঘরের সামনে গিয়ে ঘুমন্ত পরিবারগুলোর কাছে গিয়ে হাজির হয় কম্বল নিয়ে। সেখানকার ৪০ টি পরিবাররের প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে রাতের আধাঁরে কম্বল বিলায় ডিসি।
মুজিবনগড়ে সখি বেগম (৬০) নামে এক বৃদ্ধার সাথে আলাপকালে বললেন ঘরের বেড়ার ফুটা দিয়ে বাতাস ঢুকিলে হামরা নিন্দিবা পারিনা । দিনত নিন্দিবা পাড়িনা আইতত নিন্দিবা পারিনা ওও হো,.. এলা একটা মাইয়া আইচ্চে, আইতত হামাক ডাকায় উঠাইছে, মোর সাথে কথা কহিছে মোর ছুয়া পুতালা কি কচ্ছে জিগাস কইল্লে? এরপর মোক দুইখান কম্বল দিছে। দেখেছু হামার মত গরীবলার ঘরত ঢুকে হেনে কম্বল দেছে সবাকে। এ সময় নদী তিরবর্তি গ্রাম মুজিবনগড়ের (তুলারডাঙ্গা)র ঘরে ঘরে ঢুকে জাগিয়ে তুলে প্রতিটি পরিবারের মাঝে কম্বল বিতরনের পাশাপাশি খোঁজ খবর কুশল বিনিময় করেন সাবিনা ইয়াসমিন।
মুজিবনগড়ে কম্বল বিতরনে যোগ দেয় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট। এছাড়াও পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল মান্নান কম্বল বিতরনের সময় উপস্থিত ছিল।
জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন পঞ্চগড় একটি শীত প্রবন জেলা। প্রায় দশ লাখ জনগোষ্টির বসবাস এখানে। জেলায় এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ হতে ২১ হাজার দুইশতটি কম্বল বিতরন করেছে। ৩০ লাখ টাকার শীতবস্ত্র ক্রয় করে বিতরন সম্পন্ন করেছে । এছাড়াও আরও ৫ লাখ টাকার শিতবস্ত্র ক্রয় করা হয়েছে বিতরনের জন্য । তিনটি পৌরসভায় সাড়ে চার লাখ টাকার শীতবস্ত্র ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে ।এখানকার একটি বিরাট অঙ্কের জনগোষ্টি শিতার্ত। জেলার একটি মানুষও যাতে এই শীতে কস্ট না পায় সেজন্যই আমি রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রকৃত শিতার্তদের খুঁজে বের করে কম্বল বিতরনের উদ্যোগ নিয়েছি।