
আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আইওয়া থেকে আপনার কণ্ঠ মুঠোফোনে যখন শুনি, তখন মনে হয় আপনি আমার খুব কাছেই আছেন। আপনার মুখে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই কবিতার মতো। আপনি যেন কথার বদলে কবিতা বলছেন। আপনার কথা শুনে আমার মনে যে দ্যোতনার তৈরী হয়, যে রহস্যের সৃষ্টি হয় তা অনেকটা অপ্রত্যাশিত হীরকখন্ডের মতো। তাকে কোথায় তুলে রাখি, কোথায় ধারণ করি, কোথায় গেঁথে রাখি বুঝতে পারি না। দিনের আলো বাস্তবতায় সব গিলে খায়। দিনে ও রাতে আমার এখন ভিন্ন দুটি সত্ত্বা। দিনে এক রকম। রাতে আর এক রকম । দিনের আলো ফুটলেই বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ায়। ছঁুটতে হয় নিজস্ব ধারায়।
সন্ধ্যার পর রাত নেমে এলে আমি আমাকে হাতের তালুতে নিয়ে গভীর মগ্নতায় একা হয়ে যাই। একা হয়ে গেলেই আমি শব্দের সাথে খেলতে থাকি। গভীর ভাবনায় ডুবে যাই, আবার উঠি। ভাবনা- চিন্তা গুলো দ্রুত গতিতে পাল্টে যায়। কে কাকে খামছে ধরবে প্রতিযোগীতা করে। ঝটপট লিখে ফেলি কিছু। ঘুমপরী চোখে ভর হলে বিছানায় চলে যাই। ঘুম থেকে জেগে টেবিলে রাখা তিনটি রুটি দেখে জীবনের হিসেব পাল্টে যায়। মনে হয় ঘুমটাই শান্তির ছিল। জেগে ঊঠাই বড় জ্বালা। তিন বেলা পেটে খাদ্য দাও। ঔষধ খাও। পানি খাও। অসহ্য বোধ হলেও বাধ্য হই।
ম্যাসেঞ্জারে আপনার সাথে আমার দুই বছর আগে পরিচয়। আপনি কল দিয়ে বলেছিলে, মখদুমী সাহেব বলছেন? জি! বলছি। আপনার সাথে কথা বলতে পারি? অবশ্যই, কে বলছেন আপনি? এরপর আপনি আপনার পরিচয় ও ঠিকানা জানিয়েছিলেন। ‘বিএনপিকে বেছে নিতে হবে পথ’ এবং ‘বাহ্ প্রধানমন্ত্রী, ছি ! রাজনীতি’ আমার এই দুটো লেখা নিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন- কার কেমন লেগেছে জানি না। তবে আপনার দুটো লেখা পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। শব্দ ব্যবহারের সর্তকা ও ব্যঞ্জন ভালোই করেন। তাই আপনাকে ফোন দিয়েছি। আপনার ফোন পাবার পর আমার উৎসাহের অনুভূতি কেমন ছিল তা বোঝানো যাবে না। কয়েকদিন খুব আনন্দে ছিল আমার লেখক সত্ত্বা। আপনি আমাকে আপন করে নিয়েছেন, ফোন দিয়ে কথা বলেন। এটি আমার পরম পাওয়া। আপনার প্রমোশনে খুব খুশি হয়েছি। এখন আপনার জন্য দীর্ঘ জীবনের আয়ু চেয়ে প্রার্থনা।
আপনি প্রায়ই বলতেন, রংপুরের মতো ছোট একটি জেলা শহরে সাংবাদিকতা করে আপনার জীবন সংসার চলে কী ভাবে? আপনার মন ভালো থাকে কিভাবে? প্রাঞ্জল লেখেন। কোথাও দুঃখবোধ নেই। হতাশা নেই। কী ভাবে মনটাকে ভালো রাখেন? আপনার ভয়েসটা কতো সুন্দর আপনি জানেন না। ঢাকায় চলে যান। আমার বন্ধুদের বলে দেবো। টিভিতে কাজ করবেন। ভালো বেতন ও পাবেন। জীবন বদলে যাবে।
আমি আমার নাভিপোতা স্থান ছাড়তে চাই না। এটা জেনে আপনি বলেছিলেন-আমি কিন্তু হিজরত করেছি জীবনের প্রতিষ্ঠার জন্য। সবাইকে ছেড়ে আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আইওয়ায় পড়ে আছি। জীবনে হিজরত করা কখনো কখনো জরুরী হয়ে পড়ে। মহানবী (সাঃ) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন।
স্যার, আপনি আমার চেয়ে ১৯ বছরের সিনিয়র। চাইলেই আপনি আমার বয়সে ফিরতে পারবেন না। আবার আমি চাইলেই কেঁটে যাওয়া ১৯ বছর বয়সে ফিরতে পারবো না। এই যে আমাদের জীবনের আয়ু ক্ষয়ে যাচ্ছে। এটি আমাকে খুব করে টেনে ধরে। তাই জীবনের শেষ অংক আমি জেনে গেছি। বুঝে গেছি। গন্তব্য এখন চোখের সামনে দেখতে পাই। আমার কাছে পৃথিবীটা একটি অদ্ভুত গ্রহ। এ গ্রহে যারা আসে, ফিরে যাবার পর সময় তাদের মনে রাখে না। রাখলেও কোন লাভ নেই। কারণ মৃত্যু মানুষকে কেউ সম্মুখ উপকার করতে পারে না। সাহায্য করতে পারে না। মহান রবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশে যতটুকু নেক আমল করেছে। ভালো কাজ করেছে। সম্বল ততটুকুই। জীবন এবং মৃত্যুর এই রহস্যময়তা আমাকে পথ দেখিয়েছে। তাই জান্নাত ও জাহান্নামকে দু’হাতের তালুতে নিয়ে নীল জোছনায় জীবনের জল পথে শব্দ তুলে হাঁটি। উপভোগ করি সৃষ্টির সৌন্দর্য। অর্থ-বিত্ত বৈভব আমার চাই না। ততটুকু চাই যতটুকু হলে জীবন চলে যাবে।
আত্ন কথন-৩
সাংবাদিক ও লেখক।