
পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। মোটরসাইকেল যাত্রায় চারপাশের দৃশ্য খোলাখুলি দেখা যায়। চোখে পড়েছিল সবুজ ধান ক্ষেত, উপরে ছায়ার মতো আকাশ। লেপের মতো মেঘ মালা। ক্ষেতে আলু তোলায় নারী পুরুষের ব্যস্ততা। মোড়ের দোকান গুলোতে যুবকদের আড্ডা। রান্নায় ব্যস্ত গৃহবধু। কিশোর কিশোরীদের গ্রামীন খেলায় মেতে থাকা। পথে অসংখ্য ফেরিওয়ালা। তথ্য নেয়ার কাজটি সেরে ইটাকুমারী জমিদার বাড়ীতে গেলাম। ছোট ছোট লাল ইটের তৈরী দ্বি-তলা নান্দনিক পরিত্যাক্ত একটি প্রাসাদ। বিশাল পুকুর। সামনে মাঠ। দেবী সিংহ নামের একজন রানীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৭৮৩ সালে এখানেই ঐতিহাসিক প্রজা বিদ্রোহ সংঘটিত মনে হয়েছিল। ইটাকুমারী রাজার ভগ্ন প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, এখানে মানুষ ছিল। যৌন্যতা ছিল। সুখ ছিল। আনন্দ উল্লাস ছিল। উম্মাদ দখলদারিত্ব ছিল। শাসন ছিল। কালের চক্রে তা ধ্বংস হয়ে গেছে। সময় গিলে খেয়েছে সব।
যোহর নামের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। একটি মসজিদ খঁুজে পেলাম। অযু করে নামাজে দাঁড়িয়েছি। ফরজ নাম শেষ করেছি। পাশে একজন লোক নামাজে দাঁড়িয়েছে। আঁড় চোখে দেখছি, লোকটি সেজদায় দীর্ঘ সময় দিচ্ছেন। আমি নামাজে যতটা ধীরস্থিরতা অবলম্বন করি তারচেয়েও বেশী করছেন তিনি। লোকটির নামাজ শেষ করার অপেক্ষায় বসে আছি। লোকটি তার দীর্ঘ সেজদাময় নামাজ শেষ করলেন। কথা বললাম। বয়লার মুরগী কেঁটে বিক্রি করেন। সকালে বাজারে আসেন, রাতে ফেরেন। যতটুকু আয় হয় তা দিয়েই চলে সংসার। ‘দুনিয়াটা অস্থায়ী ধেঁাকার জায়গা। আল্লাহ বান্দাকে সেজদা করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। সেজদায় মধু আছে। সেজদায় গিয়ে আল্লাহকে সব কথা বলা যায় । মনটা হালকা হয়।’ ফিরছিলাম আর মনে হচ্ছিল তার ওই কথা গুলো। কী সুন্দর অভিব্যক্তি। ইসলামের সোনালী দিন সৃষ্টি করেছিল ওই রকম নামাজী মুসলমানরাই।
আমরা একটি নতুন সভ্যতায় প্রবেশ করেছি। ইউটিউবে, ফেসবুকে, গুগলে ইসলামের সুমহান শিক্ষা, মাসয়ালা মাসায়েল, ইসলামী আইন, বিধি-বিধান, আল-কোরআন ও হাদিসের বাংলা ব্যাখ্যাসহ অনুবাদ সহজেই জানাতে পারছি। এসি লাগানো আধুনিক মসজিদ। অযু করার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন পানি। মেঝেতে বিছানো কার্পেট, টাইলস। ডিজিটাল ঘড়ি। আজান প্রচারে মাইক। ইমামের জন্য সুন্দর দামি মেহরাব ও ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম। আগে এরকম ছিল না। সীমিত বই পুস্তকে ইসলামের শিক্ষা মাসয়ালা মাসায়েল, ইসলামী আইন, বিধি-বিধান জানার সুযোগ ছিল। হ্যারিকেনের আলো ছিল। অজু করার জন্য পাতকুয়া, টিউবওয়েল ও বদনা ছিল। মেঝেতে পাটের চট ছিল। কোথাও মাইক ছিল, কোথাও ছিল না।
নতুন এই সভ্যতায় প্রত্যেক মুসলমান জানে- নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ফরজ। মানে, সাধ্য থাকলে হজ্ব করবে, যাকাত দেবে। এছাড়া নামাজ, রোজা অবশ্যই পালনীয়, ফরজ। মুসলমানদের সামনে মহাগ্রন্থ আল কোরআন রয়েছে। ব্যাখ্যা হিসেবে রয়েছে রাসুল (সাঃ) এর হাদিস। রয়েছে ফকীহ গনের মতামত সম্পর্কিত ফেকাহ গ্রন্থ। ৯০ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশে ইসলাম হেফাজতের নামে একটি অরাজনীতিক সংগঠন তৈরী হয়েছে। সংগঠনটির নাম হেফাজতে ইসলাম। তাদের ১৩ দফা দাবি আমি পড়েছি। যারা দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে তারাও মুসলমান। দাবি গুলো যৌক্তিক এবং গ্রহণ যোগ্য কি না তা বিবেচনায় নেয়ার আগেই হেফাজতে ইসলাম সংগঠনটির নেতৃত্ব নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাদের ১৩ দফা দাবি চাপা পড়েছে। প্রসঙ্গটি অনেক বড় তাই এখানেই থামতে হলো।
কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনে হেফাজতে ইসলামের কোথায় ঘা লেগেছে তাই চিন্তা করছি। ভারত বাংলাদেশের বন্ধু প্রতিম দেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা বাংলাদেশের পাশে ছিল। তাই সীমান্ত হত্যাসহ নানা বিষয় হজম করে বাংলাদেশ এই সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখতে চায়। কারণ দেশের তিন দিকে ভারতীয় সীমান্ত। একদিকে বঙ্গপসাগর। বাংলাদেশে যে কোন দল সরকার গঠন করুক না কেন ভারত সরকারকে নানা কারণে প্রয়োজন রয়েছে তাদের। আগে বিএনপি এবং এরশাদ সরকারও তাই করেছিল।
২৬ মার্চ ২০২১ শুক্রবার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা বায়তুল মোকারম মসজিদে বিক্ষোভ করার চেষ্ঠা করেছে। পুলিশ বাঁধা দিয়েছে। পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। সেই সূত্র ধরে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় রেলষ্টেশনে, চট্রগ্রামের হাট হাজারী এলাকায় থানা পুলিশের উপর হামলা হয়েছে। পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা হয়েছে। জীবন বাঁচাতে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। কয়েকজন মৃত্যু বরণ করেছে। পরে হরতাল ডেকে বাসে, ট্রাকে আগুন দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের উপর হামলা করে বহনকারী জীপে আগুন দেয়া হয়েছে। এছাড়া হরতালে হেফাজতে ইসলামের নেতারা তলোয়ার হাতে ঘোড়ায় চড়ে মহড়া দিয়েছে। শিশুদের রাস্তায় বসিয়ে কোরআন পাঠ করিয়েছে। রাস্তায় নামাজ পড়েছে।
ইসলাম হেফাজতের নামে কেন এই বাস-ট্রাকে আগুন দেয়া হলো? কেন পুলিশের উপর হামলা হলো? কেন অবুঝ শিশুদের রাস্তায় নামনো হলো ? কেন ঝরে গেল কয়েকটি জীবন? কেন দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করা হলো? এর জবাব দিতে হবে হেফাজত নেতাদের। মোদির বাংলাদেশ সফরে ইসলামের কী ক্ষতিটা হয়েছে বলুন তো !। তবে খুব বড় ক্ষতি হয়ে গেছে বিশ্ব দরবারের সম্প্রতি মাথা উঁচু করে তোলা ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের।
যে দেশে ফজরের আজানে ভোর হয়। মাগরিবের আজানে সন্ধ্যা নামে। যে দেশে হাজার হাজার মসজিদের মিনার থেকে আজানে ধ্বনি বাতাসকে পাল্টে দেয়। যে দেশের মাটিতে লাখ লাখ কোরআনে হাফেজ তৈরী হচ্ছে। যে দেশের মসজিদ গুলোর দ্বার সব সময় খোলা থাকে। যে দেশের মুসলমানরা স্বাধীন ভাবে ধর্ম পালন করছে। যে দেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের। যে দেশের মুসলামান ধর্মভীরু। সেই বাংলাদেশে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড়াবার সাহস কারো নেই।
ইসলাম তরবারির ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসলাম এসেছে শান্তির পথ ধরে। তবে হরতালে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের আক্রমনাত্নক খন্ড খন্ড যে সব দৃশ্য দেখেছি তা ছিল ভয়ংকর। ইসলামের সুমহান শিক্ষার বিপরীদ। প্রশ্ন উঠেছে, হেফাজতে ইসলাম কি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চায়? দেশে বিপ্লব ঘটাতে চায়? তাদের সে রকম শক্তি সাহস কি আছে? ছোট এই দেশে বিপ্লব ঘটাবার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি কি আছে? অথবা বিপ্লব ঘটাবার মতো আধ্যাত্নিক নেতা তাদের মধ্যে তৈরী হয়েছে কী? ইসলামের পর্যাপ্ত জ্ঞানের আলো হেফাজত নেতাকর্মীদের আছে কি? তারা কি মহাগ্রন্থ আল কোরআনেরা আয়াত গুলোর সঠিক ব্যাখ্যা শিখেছে? তারা কি ইসলামের শিক্ষায় ব্যক্তি জীবন গড়তে পেরেছে? উন্নত চরিত্র গঠন করতে পেরেছে ? তারা কি দীর্ঘ সেজদায় নামাজ পড়েন? কি পেরেছে জানি না। তবে আমার তৃতীয় চোখ জানিয়েছে, হেফাজতে ইসলাম ইসলাম রক্ষার আড়ালে মোদির সফরকে কেন্দ্র করে অন্য কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। অরাজনীতিক এই সংগঠনটি শক্তি মত্তা প্রদর্শন করে সরকারকে ঈঙ্গিত দিয়েছে আমরা ও পাওয়ারফুল। তবে কি হেফাজতে ইসলাম এখন অন্য কারো এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যম?
দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি জামাত জোট। তাদের বাঘা বাঘা নেতারা নিশ্চুপ। কামাই টামাই করতে পারছে না তাই নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ। মামলা, মামলায় নাজেহাল। সরকার তাদের দমিয়ে রেখে ধারাবাহিক কাজ করতে চাইবে, এটি স্বাভাবিক। বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় আসার চেষ্ঠা করবে। অথবা একদিন ক্ষমতায় আসবে, আসতেই পারে। এটিও স্বাভাবিক। কারণ সময় সব সময় পালাবদলের পক্ষে। এটি ইতিহাসের কথাও। দেশের প্রগতিশীল মানুষরা কোথাও ঠাঁই পাচ্ছে না। বিএনপি জামাত জোটের মতো প্রগতিশীল মানুষদের মধ্যে সরকার বিরোধী ক্ষোভ জন্মেছে। আবার দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে জনগণের মধ্যে সরকার বিরোধী একটি ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের হরতালে সামগ্রীক একটি ক্ষোভের অস্পষ্ট ছাপ দেখেছি। মনে হয়েছে, সকল সুবিধা পাবার পরও সরকারে উপর নানা কারণে ক্ষুব্ধ জনগণের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের নীতি নির্ধারনী মহল বিষয়গুলো নজরে নেবে, এটা চাই।
হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বলতে চাই, আপনারা ইসলাম হেফাজত করার আগে নিজের/ আপনার/ আপনাদের ব্যক্তি জীবনের হেফাজত করুন। কোরআন ও হাদিসের আলোকে ব্যক্তি জীবন গড়–ন। কথায়, কাজে, ব্যবহারে, ব্যবসায়, বানিজ্যে কিংবা সংসারে ইসলামী নিয়ম মেনে চলুন। আমলিয়াতের সোনালী জীবন গড়–ন। আল্লাহ তায়ালার সন্তুুষ্ঠির উদ্দেশ্যে সব কাজ করুন। যেমন ছিলেন রাসুল (সাঃ) এর সাহাবীরা। অথবা পীর মাশায়েখগণ। মহান আল্লাহ, আপনার উপর যেন রাজী খুশি হন। বোমা লাগবে না। বন্ধুক লাগবে না। আগুন জ্বালাতে হবে না। ব্যক্তি জীবনের ইসলামী আদর্শের সৌন্দর্য বিকশিত হলে পরিবার বদলে যাবে। সমাজ বদলে যাবে। সমাজ বদলে গেলে দেশ বদলে যাবে। ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে নিজেকে ইসলামী আদর্শে বদলে দেয়ার যুদ্ধ শুরু করুন। সবাই জানে, পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী হয় না। যতই ক্ষমতাধর হোক, জ্ঞানী হোক কিংবা অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হোক। একদিন মৃত্য এসে সব কিছু ভেঙ্গে দেবে। ইটাকুমারীর ওই শুন্য প্রাসাদের মতো। মুসলমানদের মৃত্যুর পর কবরে জীবিত করা হবে। তিনটি প্রশ্ন করা হবে। তার জবাব সন্তোষজনক হলে জান্নাতের সাথে কবরের সংযোগ ঘটিয়ে শান্তির ঘুম দেয়া হবে। জবাব সঠিক না হলে জাহান্নামের সাথে কবরের সুরঙ্গ করে দেয়া হবে। জ্বলতে থাকতে হবে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় না হওয়া পর্যন্ত। এরপর কেয়ামত সংঘটিত হলে পুনরুত্থিত করা হবে, পুনঃরায় জীবন দেয়া হবে। প্রশ্ন করা হবে পৃথিবী জীবনের সকল কথা ও কাজের। তখন কি জবাব দেবেন? এই হত্যা, আগুন দিয়ে ক্ষতি করার।
আপনারা ইসলামী ওয়াজ মাহফিলে এইসব কথাই বলেন। আপনারা অনেক জানেন। আমরা শুনি। তাই আমি কিছু বলিনি। আমি কিছু লিখিনি। প্রগতিশীল চিন্তার এই মহিউদ্দিন মখদুমীর জীবন বদলে দিয়েছে সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু নামের এক ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু। জীবন ও মৃত্যুর অংক মিলাতে গিয়ে কোরআন, হাদিস ও ইসলামী বই পাঠ পরিবর্তন করে দিয়েছে আমার জীবনের গতিপথ। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু দরকার চাই ততটুকু। ছুটি, ছুটে বেড়াই, পেশাগত দায়িত্ব পালন করি এ জন্যই। জেনে গেছি, পৃথিবী জীবনের ভালো কাজের সুফল একদিন মহান আল্লাহ দেবেন। মন্দ কাজের সাজাও দেবেন। জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও মৃত্যুর পরে মহাজীবন রয়েছে। কোরআন, হাদিস ও ইসলামী বই পাঠ করতে করতে আমার ভিতরে একটি সত্ত্বার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সত্ত্বা আমাকে সব সময় সর্তক করে। পানকৌড়ির মতো ডুব দিয়ে গভীর তলে নিয়ে যায়। সেখানে একটি জ্বলজ্বলে আশার আলো দেখতি পাই। যিনি এই জীবন দিয়েছেন। বেঁচে থাকার উপকরণ দিচ্ছেন। গোটা পৃথিবী যার ইশারায় চলে। যার কাছে প্রস্থান করতেই হবে। সেই মহান আল্লাহকে মাথা ঠেকিয়ে, কপাল ছুঁইয়ে, হাত ও পা নত করে, পুরো শরীর ঝুঁকিয়ে কৃতজ্ঞতায় ফি সময় সেজদায় নত হই। আনন্দ অনুভব হয়। ঝরঝরে অনুভব হয়। একটি তৃপ্ততা ছুঁয়ে যায়।
না। আমি কিছু লিখিনি। ওই সত্ত্বা সজাগ হয়ে আমাকে দিয়ে এই লেখাটি লিখিয়েছে।
আত্ন কথন-৮
সাংবাদিক ও লেখক।